Sunnah Health Care

থ্যালাসেমিয়া (Thalassemia): কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

থ্যালাসেমিয়া একটি জেনেটিক বা বংশগত রক্তের রোগ, যেখানে শরীরে পর্যাপ্ত সুস্থ হিমোগ্লোবিন তৈরি হয় না। হিমোগ্লোবিন হলো লোহিত রক্তকণিকার (RBC) ভেতরে থাকা প্রোটিন, যা শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন বহন করে। যখন হিমোগ্লোবিন যথেষ্ট তৈরি হয় না, তখন রক্তাল্পতা (Anemia) দেখা দেয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর তথ্যানুযায়ী, বিশ্বজুড়ে লাখো মানুষ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত এবং বাংলাদেশে প্রতিবছর হাজার হাজার শিশু এ রোগ নিয়ে জন্ম নিচ্ছে।


থ্যালাসেমিয়া কীভাবে হয়?

থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ। অর্থাৎ বাবা-মা কেউ একজন বা উভয়ই যদি থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করেন, তবে সন্তান এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

  • যদি উভয় অভিভাবকই থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার হন, তবে সন্তানের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
  • যদি শুধু একজন অভিভাবক ক্যারিয়ার হন, তবে সন্তান সাধারণত আক্রান্ত হয় না, কিন্তু ক্যারিয়ার হতে পারে।

থ্যালাসেমিয়ার প্রকারভেদ

  1. আলফা থ্যালাসেমিয়া (Alpha Thalassemia)
    • আলফা গ্লোবিন চেইন উৎপাদনে সমস্যা হয়।
    • গুরুতর হলে গর্ভকালেই ভ্রূণ মারা যেতে পারে।
  2. বিটা থ্যালাসেমিয়া (Beta Thalassemia)
    • বিটা গ্লোবিন চেইন উৎপাদনে সমস্যা হয়।
    • এর মধ্যে আবার দুই ধরনের ভাগ আছে:
      • বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর → খুব গুরুতর, নিয়মিত রক্ত নিতে হয়।
      • বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (Trait/Carrier) → সাধারণত কোনো বড় উপসর্গ থাকে না, তবে জেনেটিকভাবে বহন করে।

থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ

থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ নির্ভর করে রোগ কতটা গুরুতর তার উপর। সাধারণত দেখা দিতে পারে:

  • অবসাদ ও দুর্বলতা
  • রক্তাল্পতা (Anemia)
  • ত্বক ফ্যাকাশে বা হলদে হয়ে যাওয়া
  • শিশুদের বৃদ্ধি ধীর হয়ে যাওয়া
  • অস্থি বিকৃতি (হাড় চওড়া হয়ে যাওয়া, মুখের হাড়ে পরিবর্তন)
  • প্লীহা (Spleen) বড় হয়ে যাওয়া
  • ঘন ঘন ইনফেকশন হওয়া

থ্যালাসেমিয়ার জটিলতা

চিকিৎসা না করলে থ্যালাসেমিয়া থেকে নানা জটিলতা হতে পারে:

  • গুরুতর রক্তস্বল্পতা
  • হার্ট ও লিভারের জটিলতা
  • অতিরিক্ত আয়রন জমা হওয়া (Frequent transfusion-এর কারণে Iron Overload)
  • হাড় দুর্বল হয়ে যাওয়া (Osteoporosis)
  • শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক বিকাশে সমস্যা

নির্ণয়ের উপায়

  • Complete Blood Count (CBC) → রক্তাল্পতা আছে কি না দেখা হয়।
  • Hemoglobin Electrophoresis → হিমোগ্লোবিনের গঠন পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় করা হয়।
  • DNA Test → জেনেটিক টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়।

চিকিৎসা

বর্তমানে থ্যালাসেমিয়ার স্থায়ী নিরাময় নেই। তবে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে রোগী স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে।

  • নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন (Blood Transfusion) → হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি পূরণ করে।
  • Iron Chelation Therapy → শরীরে অতিরিক্ত আয়রন জমা হলে তা বের করে দিতে বিশেষ ওষুধ দেওয়া হয়।
  • Bone Marrow Transplant (BMT) → কিছু ক্ষেত্রে এটি স্থায়ী চিকিৎসা হতে পারে, তবে খরচবহুল ও জটিল।
  • সহায়ক চিকিৎসা → স্বাস্থ্যকর খাবার, ভ্যাকসিনেশন, সংক্রমণ প্রতিরোধ, নিয়মিত ডাক্তারি পরামর্শ।

প্রতিরোধ

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব বিয়ে ও সন্তান পরিকল্পনায় সচেতনতা অবলম্বন করে।

  • বিয়ের আগে থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার টেস্ট করানো উচিত।
  • যদি উভয়েই ক্যারিয়ার হন, তবে সন্তান জন্মের আগে জেনেটিক পরামর্শ নিতে হবে।
  • জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ ব্যবস্থা।

উপসংহার

থ্যালাসেমিয়া একটি গুরুতর বংশগত রোগ হলেও সচেতনতা, নিয়মিত চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সমাজে প্রতিটি মানুষ যদি বিয়ের আগে ক্যারিয়ার টেস্ট করান, তবে নতুন প্রজন্মকে থ্যালাসেমিয়ার মতো কষ্টকর রোগ থেকে রক্ষা করা যাবে।

👉 তাই এখন থেকেই সচেতন হোন, টেস্ট করান এবং আপনার পরিবারকে নিরাপদ রাখুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *